1. admin@news24hour.net : admin :
পিতা মাতার ভরণপোষণঃ প্রেক্ষিত বাংলাদেশ - নিউজ ২৪ আওয়ার
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০১:৫২ অপরাহ্ন

পিতা মাতার ভরণপোষণঃ প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

  • প্রকাশিত : বৃহস্পতিবার, ১৯ জানুয়ারি, ২০২৩
  • ২৩৩ বার পঠিত

জন্মদাতা মা-বাবার প্রতি তাদের নিজ সন্তানের ভরণপোষণ ও পরিচর্যা করা একটা অবশ্য পালনীয় দায়িত্ব। সারাজীবন একজন মা-বাবা তার নিজ ছেলেকে শিক্ষায়-দীক্ষায় মানুষ করবার জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যায়। এর ফলশ্রুতিতে একটা সন্তান মানুষের মতো মানুষ হয় নিজ পেশায় অধিষ্ঠিত হয়ে যায়। একজন আদম সন্তানের নিজ পেশা/কাজে প্রতিষ্ঠিত হবার পিছনে সবচেয়ে অবদান বেশি বাবা মায়ের, এরপরে শিক্ষকদের অবদান থাকে। প্রত্যেকটা প্যারেন্টস যদি তাদের প্যারেন্টিং টা সঠিকভাবে না করতে পারতো, তাহলে তাদের সন্তান মানুষের মতো মানুষ হয়ে উঠতো না।

পিতা মাতার ভরণপোষণ দায়িত্ব টা সত্যিকার অর্থেই একটি মানবিক ও পারিবারিক দায়িত্ব। তাই এ দায়িত্ব শুধুমাত্র আইন কিংবা জরিমানা দিয়ে প্রতিপালন সম্ভব নয়। এর জন্য প্রকৃতভাবে উচ্চমাত্রার মানবিক ও নৈতিকতা বোধ, ধর্মীয় অনুশাসনের প্রতি শতভাগ আস্থা স্থাপনসহ প্রতিপালন করা, মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধ করা প্রয়োজন।

৫০-৬৫ বছর এর উর্ধে উঠা সিনিয়র সিটিজেনদের রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্পূর্ণভাবে বিনামূল্যে চিকিৎসা ব্যবস্থা করা, সম্পূর্ণভাবে বিনামূল্যে পরিবহনে আরোহন সহ নানাবিধ সুবিধা প্রদান করতে হবে। পরিবারের পাশাপাশি রাষ্ট্রযন্ত্রকেও সমানভাবে প্রতিনিয়ত সিনিয়র সিটিজেনদের কল্যাণের নিমিত্তে কাজ করতে হবে।

মূলত বেচে থাকার জন্য প্রত্যেক নাগরিকের উচিৎ হলো আইন জানা৷ বাধ্যতামূলকভাবে আপনাকে আইন জানতে হবে, পরিবারকে জানাতে হবে এবং আইন অনুযায়ী নিজেকে/পরিবারের সকল সদস্যদের পথ চলতে উৎসাহ প্রদান করতে হবে।

জনগুরুত্বপূর্ণ এই আইন নিয়ে আলোচনার উদ্দেশ্যই হলো আইন টি সাধারণ মানুষের নিকটে পৌছে দেয়া। বাংলাদেশের প্রত্যেকটা নাগরিক এই আইন সম্পর্কে জানুক, প্রত্যেক ভরণপোষণ বঞ্চিত পিতামাতা/দাদা-দাদী/নানা-নানী জানুক যে তাদের জন্য আইন বিদ্যমান রয়েছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রযন্ত্র বের হয়ে আসুক।

প্রত্যেকটা মানুষের জীবনে শেষকাল/বৃদ্ধকাল আসবে, এটা প্রকৃতি প্রদত্ত। এটা ডিনাই করার কোন সুযোগ নেই। আদতে আজকের একজন যুবকও কয়েক বছর পরে বৃদ্ধ/বিকলাঙ্গ হতে পারে।

এজন্য প্রত্যেকটা সন্তানের উচিত তার নিজ মা-বাবার পরিচর্যার জন্য নিরলস কাজ করে যাওয়া এতে করে তার পারিবারিক দায়িত্ব পালন হবে এবং ইসলামে বাবা-মায়ের সেবা করবার জন্য প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে অনেক কিছু বলা হয়েছে।

এসব সত্ত্বেও আজকাল পত্রিকার পাতা খুললেও দেখা যায়, অনেক সন্তান তার নিজ বাবা-মা কে ফেলে দিচ্ছে, কোন প্রকার ভরণপোষণ দিচ্ছে না। এতে করে সমাজে একটা নেগেটিভ ম্যাসেজ চলে যাচ্ছে, এবং এ বিষয়টি অত্যন্ত ন্যাক্কারজনক অবস্থায় গিয়ে পৌছেছে যা আসলেই দূঃখজনক। এখনকার সামাজিক প্রেক্ষাপটে পিতামাতার প্রতি অবহেলা দিন দিন নানাবিধ কারণে বেড়েই চলেছে।

শিক্ষা-কর্মসংস্থান সহ নানাবিধ কারণে গ্রামের পিতামাতা একদিকে যেমন একাকী হয়ে যাচ্ছে এবং সেইসাথে তাদেরকে তাদের জীবনের শেষ পর্যায়ে থাকা-খাওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তার মধ্য দিয়ে দিনানিপাত করতে হচ্ছে; এটা অত্যন্ত অমানবিক, পাষবিক হিংস্রতা বলে মনে করি।

বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে এখনো সবার জন্য পেনশন স্কীম চালু করা সম্ভব হয়নি যদিও এটা নিয়ে সরকার ব্যাপকভাবে কাজ করবে বলে পেনশন আইন নিয়ে বেশ তোড়জোড় চালাচ্ছে এবং ইন্সায়াল্লাহ বড় ধরনের একটা কাজ হবে বলেও আশা প্রকাশ করা যায়। কিন্তু দেশ মুক্ত হবার ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও সকল নাগরিকদের জন্য পেনশন প্রাপ্তি এখনো অনেকটা সূদুর নীহারিকার মতো। এজন্য শেষ বয়সে এসে অনেও ব্যক্তি এখন ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইসিস এর পড়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশে যথেষ্ট Old Home/বৃদ্ধাশ্রম গড়ে উঠেনি, কিছু কিছু জায়গায় গড়ে উঠলেও বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এখনো এসব ওল্ড হোমে যাওয়াটাকে ভালো মনে করে না। এখানে এখন অনেকটা বাধ্য হয়েই শেষ বয়সে অনেকে এসব ওল্ড হোম বেছে নেয়। কিন্তু ইউরোপের দেশগুলোতে প্রায় অনেকেই জীবন সায়াহ্ন অবস্থায় ওল্ড হোমে চলে যায় কারণ – ওল্ড হোমে নানাবিধ সুবিধা পাওয় যায়, আড্ডা দেয়ার মানুষ পাওয়া যায়, চিকিৎসা সহ নানাবিধ সুবিধা পাওয়া যায়, লাইফ ইন্স্যুরেন্স কাভারেজ সহ নানাবিধ আইনগত ইস্যু দেখাশুনার জন্য যোগ্য ব্যক্তি পাওয়া যায়। এসব নানাবিধ সহযোগিতা পাওয়া যায় বিধায় ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ওল্ড হোম জনপ্রিয়। কিন্তু বাংলাদেশে এখনো ওল্ড হোম জনপ্রিয় হয়নি।

বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ লাইফ ইন্স্যুরেন্সে সম্পর্কে জ্ঞাত নয়, এবং প্রচুর সংখ্যক মানুষের এখনো অবধি লাইফ ইন্স্যুরেন্স করা নেই। এমতাবস্থায় এখানকার মানুষজনের চিকিৎসা ব্যয় মেটানো অনেক কঠিন একটা বিষয়। লাইফ ইন্স্যুরেন্স, হেলথ ইন্স্যুরেন্স প্রত্যেকটা মানুষের জন্য বাধ্যতামূলক একটা বিষয়। কিন্তু এসব ব্যাপারে যে দপ্তরের ব্যাপকভাবে কাজ করবার কথা ছিলো, তাদের আরও প্রচুরপরিমাণে কাজ করা উচিৎ বলে মনে হচ্ছে। লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি গুলোকেও আস্থাশীল হয়ে এদেশে কাজ করতে হবে, তাহলে দেশের প্রত্যেকটা মানুষের বৃদ্ধকালের নিরাপত্তার জন্য ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইসিস কেটে যাবে বলে মনে করি।

পিতা মাতার ভরণপোষণ আইন, ২০১৩ নামে একটা আইন এদেশে প্রণয়ন করেছিলেন আওয়ামীলীগ অধীন মহাজোট সরকার। ২০১৩ সালে তৎকালীন মহাজোট সরকারের পক্ষ থেকে এই আইনটা করা হয়। এই আইনের ২(খ) তে বলা হয়েছে শুধুমাত্র খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা, বাসস্থান দিলেই হবে না পাশাপাশি বাবা-মা কে সঙ্গ দিতে হবে। এবং আইনে এটাও বলা আছে যে, পিতার অবর্তমানে দাদা-দাদী এবং মাতার অবর্তমানে নানা-নানীর ভরণপোষণের দায়িত্ব পালন করতে হবে। পিতা-মাতার/দাদা-দাদী/নানা-নানীর ভরণপোষণের দায়িত্ব যদি কেউ সঠিকভাবে পালন না করে তাহলে এক লক্ষ টাকা জরিমানা এবং ৩ মাসের কারাদন্ডের বিধান ও রাখা হয়েছে।

মামলা দায়েরের পদ্ধতি:

সন্তান যদি আইন অনুযায়ী পিতা-মাতা বা দাদা-দাদি অথবা নানা-নানিকে ভরণ-পোষণ না দেয় তাহলে তারা তিনটি সংস্থার যেকোনো একটিতে যেতে পারেন- নিকটস্থ থানা, নিকটস্থ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট অথবা জেলা লিগ্যাল এইড অফিস। জেলা লিগ্যাল এইড অফিসে গেলে লিগ্যাল এইড অফিসার অপর পক্ষকে নোটিশ দিয়ে উপস্থিত করাবেন এবং আপোষ-মীমাংসার মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করবেন। আপোষ-মীমাংসা না হলে মামলা করার পরামর্শ দিবেন। তখন ভুক্তভোগী ব্যক্তি থানায় গিয়ে এজাহার দায়ের করতে পারেন অথবা জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে মামলা করতে পারবেন। ভুক্তভোগী ব্যক্তি যদি আর্থিকভাবে অসচ্ছল হন তাহলে জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার তার জন্য সরকারি খরচে আইনজীবী নিয়োগ করে দেবেন। ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে মামলা শুরু হওয়ার পরও ম্যাজিস্ট্রেট চাইলে যে কোনো ব্যক্তির নিকট বিষয়টি আপোষ করিয়ে মীমাংসার জন্য পাঠাতে পারেন। আপোষ ব্যর্থ হলে তখন মামলা চলতে থাকবে এবং বিচারে দোষী সাব্যস্ত ব্যাক্তির শাস্তি হবে।

এই সময়ে পিতা মাতার ভরণপোষণ আইন, ২০১৩ এর অধীন অনেক আপোষ ও নিষ্পত্তিযোগ্য মামলা চলমান রয়েছে এবং এগুলোর ফলাফল/রায় ও দেয়া হয়েছে। কাজেই, বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে পিতামাতার ভরণপোষণের দায়িত্ব পালন না করলে সন্তানের বিরুদ্ধে আইনগত অভিযোগ দায়ের করা কিংবা সন্তানের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের সংখ্যা বেড়েই চলেছে; যা অত্যন্ত দূঃখজনক ও নিন্দনীয় এবং অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়।

সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে দেশ এগিয়ে গেলে এবং নাগরিকদের লাইফ ইন্স্যুরেন্স, হেলথ ইন্স্যুরেন্স বাধ্যতামূলক করা এবং সার্বজনীন পেনশন স্কিম চালু করতে পারলে ভরণপোষণ নিয়ে সংকট কমে যাবে, তারপরেও সন্তানদের উচিৎ হবে তাদের জন্মদাতা পিতা-মাতার উপর যত্নশীল হওয়া। বিভিন্ন সরকারী দপ্তর, সায়ত্তশাসিত দপ্তর, বেসরকারী দপ্তর, এন জিও, এন পিও সহ বিভিন্ন পর্যায় থেকে এই আইনের সফল প্রচারসহ এটা নিয়ে কাজ করতে হবে, তাহলে বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিক ভরণপোষণের অধিকারী হতে পারবেন।

লেখকঃ আরিফ বিল্লাহ,
লিগ্যাল কনসালটেন্ট,ঢাকা জজ কোট।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরও খবর

ফেসবুকে আমরা

© স্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২২ নিউজ ২৪ আওয়ার
Theme Customized By Shakil IT Park